Abu Bakar Siddique

মে ফ্লাওয়ার

বুক-রিভিউ

আজকাল ভ্রমনকাহিনিতে আসক্ত পড়েছি। যেহেতু আমি নিজেও একজন ভ্রমণপ্রেমি, তাই ভ্রমণ বিষয়ক যেকোনো কিছুই আমার পছন্দের শীর্ষে থাকে। এমুহূর্তে হাতের কাছে বইপত্র নেই। তাই গতকাল অনলাইনে ঘাটাঘাটি করছিলাম কোনো বইয়ের সফটকপি পাওয়া যায় কিনা। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সামনে এলো হুমায়ুন আহমেদের ‘মে ফ্লাওয়ার’ নামে একটা বই। লেখকের আমেরিকা ভ্রমণের কাহিনি নিয়ে লেখা বইটি। যেহেতু ভ্রমণকাহিনি—তাই পড়তে শুরু করলাম। তাছাড়া হুমায়ুন আহমেদের সাবলীল লেখার ভক্ত আমি। উনার মতো এতোটা সাবলীল ভঙ্গিতে লিখেছেন এমন খুব কম মানুষই আছেন আমাদের দেশে।

বইটা খুব বেশি বড় না। মাত্র ৬০ পৃষ্ঠা। পড়তে ভালোই লাগছিলো। হঠাৎ একটা অংশ পড়ে থমকে গেলাম। লেখক তার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমেরিকানদের পারিবারিক জীবনচর্যা নিয়ে লিখেছেন সেই অংশটুকু। পাঠকের সুবিধার্থে আমি সেই অংশটুকু হুবহু এখানে তুলে দিচ্ছি। 

একটি আমেরিকান পরিবারের জীবনচর্যা চিন্তা করলে কষ্ট হয়। ওরা কি হারাচ্ছে তা বুঝতে পারে না। আমরা যারা বাইরে থেকে আসি–বুঝতে পারি কিংবা বোঝার চেষ্টা করি।

একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করা যাক।

সর্বাধুনিক একটি হাসপাতালে শিশুটির জন্ম হলো। বিশ্বের সেরা ডাক্তাররা জন্মলগ্নে শিশুটির পাশে থাকলেন। সে বাসায় ফিরল কিন্তু মায়ের কোলে ফিরল না। তার আলাদা ঘর। আলাদা খাট। কেঁদে বুক ভাসালেও মা তাকে খাবার দেবেন না। ঘড়ি ধরে খাবার দেবেন। সে বড় হতে থাকবে নিজের আলাদা ঘরে। এতে নাকি তার ব্যক্তিসত্তার বিকাশ হবে।

শিশু একটু বড় হলো। বাবা-মায়ের কাছে নয় বেশিরভাগ সময় তাকে এখন থাকতে হচ্ছে বেবি কেয়ার কিংবা বেবি সিটারদের কাছে।

তার চার-পাঁচ বছর বয়স হবা মাত্র শতকরা ৮০% ভাগ সম্ভাবনা সে দেখবে তার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছেন। এই ঘটনায় তারা যেন বড় রকমের শক না পায় তার জন্যেও ব্যবস্থা করা আছে। স্কুলের পাঠ্য তালিকায় বাবা-মা আলাদা হয়ে যাবার সমস্যা উল্লেখ করা আছে।

শিশুটির বয়স বারো পার হওয়া মাত্র স্কুল থেকে তাকে জন্মনিয়ন্ত্রণের সাজসরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে। এটি নতুন হয়েছে। যাতে যৌন রোগে আক্রান্ত না হয় সেই ব্যবস্থা। বয়োসন্ধি বয়সে যখন তারা মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনে হতচকিত সেই সময়টা তাদের কাটাতে হবে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজে যাদের পরবর্তী সময়ে বিয়ে করবে। কি ভয়াবহ সেই অনুসন্ধান। একটি মেয়েকে অসংখ্য ছেলের মধ্যে ঘুরতে হবে যাতে সে পছন্দমতো কাউকে খুঁজে পায়। সময় চলে যাবার আগেই তা করতে হবে। প্রতিযোগিতা–ভয়াবহ প্রতিযোগিতা।

উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হলো–বেরিয়ে যেতে হবে বাড়ি থেকে। এখন বাঁচতে হবে স্বাধীনভাবে। নিজের ঘর চাই। নিজের গাড়ি চাই। কোনো একটি চাকরি দ্রুত প্রয়োজন।

চাকরি পাওয়া গেল। তাতেও কোনো মানসিক শান্তি নেই। চাকরি সবই অস্থায়ী। কাজ পছন্দ হলো না তো বিদায়। সংসার প্রতিপালন করতে হচ্ছে এক ধরনের অনিশ্চয়তায়। অনিশ্চয়তায় বাস করতে করতে অনিশ্চয়তা চলে আসছে তাদের আচার-আচরণে। তাদের কোনো কিছুই একনাগাড়ে বেশিদিন ভালো লাগে না। কাজেই ইস্ট থেকে ওয়েস্ট ওয়েস্ট থেকে নর্থে। এক স্ত্রীকেও বেশি দিন ভালো লাগে না। গাড়ির মধ্যে স্ত্রী বদল হয়।

এই করতে করতে সময় ফুরিয়ে যায়। আশ্রয় হয় ওল্ড হোম। জীবনের পরিণতি। এক সময় মৃত্যুবরণ করতে হয়। মৃত্যুর পর দেখা যায় তারা তাদের ধন-সম্পদ উইল করে দিয়েছে প্রিয় বিড়ালের নামে, কিংবা প্রিয় কুকুরের নামে। 

লেখক খারাপ কিছু বলেননি। বরং এটাই নির্মম বাস্তবতা। বর্তমান সময়ে এই পরিস্থিতি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসের মতো। দুঃখজনক বিষয় হলো, এর প্রতিকার নিয়ে কেউই ভাবছে না। উপরন্তু সবাই বেশ নির্বিকার ভুমিকা পালন করছে। এভাবে চলতে থাকলে এই ভাইরাস একসময় গোটা পৃথিবীতে ছেয়ে যাবে। তখন মানবজীবনে সুখ বলে আর কিছুই হয়তো অবশিষ্ট থাকবে না।

বইতে লেখক জেন নামক এক কবির আলাপ করেছেন। তিনি শ্রীলংকার কবি। খুবই মজার একটা ক্যারেক্টার। সবাইকে তিনি কবিতা শোনাতে পছন্দ করেন। তার কবিতাগুলোও একেকটা ঢাউস সাইজের। তার কবিতাপাঠ শুনে শ্রোতার ভালো লাগছে কিনা সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপই থাকে না। তিনি বরং শুনিয়েই আনন্দ পান। সেই বাচাল কবি শেষে লেখককে উৎসর্গ করে একটা কবিতাও লিখেছেন। যা আবৃত্তি করার সময় তিনি তো কেঁদেছেনই, স্বয়ং লেখকও কেঁদে ফেলেছিলেন। 

এছাড়াও লেখকের সানফ্রান্সিসকো, নিউ অরলিন্স এবং নিউজার্সি ভ্রমণের কাহিনি এখানে লেখা আছে। যদিও খুব সংক্ষিপ্ত আকারে। তবুও পড়তে ভালোই লেগেছে। তার কারণ, সাবলীল ভঙ্গিতে লেখা। এটা তার সবচেয়ে বড় গুণ। ঠিক সে কারণেই তিনি আজও অমর হয়ে আছেন। বেঁচে আছেন তার অগণিত পাঠকের হৃদয়ে।

লিখেছেন : 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আমার সম্পর্কে

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit.

গ্যালারি

আমাকে অনুসরণ করুন