ঘুম থেকে উঠে সময় দেখেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সাড়ে চারটা বেজে গেছে। অথচ আমি সাড়ে তিনটার এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় পরেই দিলাম ছুট। ভাগ্যিস সাইকেলটা ছিলো। নাহলে তো বেশ বিপদেই পড়তে হতো।
জয় বাংলা ম্যারাথনের রিপোর্টিং টাইম ছিল ভোর ৪:২০ মিনিটে। তবে দৌড় শুরু হওয়ার কথা ৫টা থেকে। আমার তার আগে পৌঁছুতে পারলেই হবে। দ্রুত সাইকেলে প্যাডেল মারছি। কিন্তু মোটামুটি নষ্টমানের একটা সাইকেলে আর কত! কোনোমতে হাতিরঝিলে পৌঁছলাম।
সহসাই আমার মনে হলো কিছু একটা মিস্টেক হয়েছে। কিন্তু কী মিস্টেক হয়েছে সেটাই ধরতে পারছিলাম না। হঠাৎ পায়ের দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া। এ কী, আমি দেখি স্যান্ডেল পরেই চলে এসেছি! তাড়াহুড়ায় সেটা খেয়ালও করিনি। এখন কী হবে?
প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ লাগছিলো। রাগের মাথায় ভাবছিলাম ওই স্যান্ডেল পড়েই ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করবো। যা হবার হবে। কিন্তু পরক্ষণেই মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করলাম, এখনো চাইলে জুতা পাল্টে আসা সম্ভব। হয়তো শুরুতে কিছুটা সময় মিস করবো। কিন্তু ৩ ঘন্টা ৪০ মিনিটের মধ্যে যদি ১০/১৫ মিনিট চলে যায়, তাহলেও ক্ষতি নেই। আমি কভার করে নিতে পারবো।
যেই ভাবা সেই কাজ। আবারও সাইকেল ঘুরিয়ে দিলাম টান। একেবারে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি। মেইন রোড, বড় বড় ট্রাক চলছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে অঘটন। তবে সেসবের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই আমার। কোনোমতে বাসায় এসে জুতোটা পাল্টে আবারও ছুট। মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচে এসে দেখি রাস্তা বন্ধ। এমনটা হবে জানাই ছিলো। তাই বেশি প্যারা খাইনি। তবে প্যারা খেয়েছি ঘুরে যেতে। একে তো ওই রাস্তা আমার কাছে একেবারে নতুন। তার উপর কোনো নির্দেশিকাও ছিলো না, কীভাবে ম্যারাথনের স্টার্টিং পয়েন্টে পৌঁছুতে হবে। আমি গুগল ম্যাপের সহযোগিতা নিয়ে কোনোভাবে সেখানে পৌঁছলাম। সাইকেলটা একজায়গায় রেখে আমি ভলান্টিয়ারদেরকে জিজ্ঞেস করলাম স্টার্টিং পয়েন্টটা কোনদিকে। আমার এই প্রশ্ন শুনে কয়েকজন ভলান্টিয়ার বলে উঠলো, ‘এতক্ষণে আসছেন? দৌঁড় তো শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। এখন গিয়ে তো কোনো লাভ নাই।’
এসব শুনে আমি খানিকটা ভড়কে গেলাম। আসলেই তো, ম্যারাথন শুরু হওয়ার ৩০-৩৫ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেছে। এতো দেরিতে শুরু করে আমি কি নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ করতে পারবো? প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলাম। হঠাৎই মনে হলো, শুরু করেই দেখি না! পারলে পারবো, না পারলে নাই। যা আছে কপালে। আমি দৌড় শুরু করলাম।
এদিকে ব্যাগ রাখারও কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাছাড়া এমন কেউই ছিলো না যার কাছে ব্যাগটা রাখবো। পরে বাধ্য হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়েই দৌড়াতে হচ্ছিলো। শুরুর দিকে বেশ প্যারা খাচ্ছিলাম। পরে ব্যাগটাকে শরীরের সাথে একেবারে এডজাস্ট করে নিলাম। তারপর আবার দৌড়।
প্রথম রাউন্ডটা কোনোভাবে শেষ করলাম। ততক্ষণে অনেককেই ধরে ফেলেছি যারা একেবারে শুরুতেই শুরু করেছিলো। তখন বেশ ভালো লাগছিলো। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস খানিকটা ফিরে পেতে শুরু করলাম। এভাবেই শুরু করলাম দ্বিতীয় রাউন্ড।
দ্বিতীয় রাউন্ডের শুরুতেই দেখতে পেলাম Jannatul Maowa আপুকে। পেছন থেকে আপুর আইকনিক হেডফোনটা দেখেই আন্দাজ করেছিলাম এটা জান্নাত আপুই হবেন। সামনে গিয়ে দেখলাম আমার ধারণাই সঠিক। আপুকে গত এক-দেড় মাস আগে থেকেই চিনি ফেসবুকের সুবাদে। বিভিন্ন ম্যারাথন কিম্বা রানিং ইভেন্টে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন তিনি। মূলত উনাকে দেখেও বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আজ সরাসরি উনাকে দেখে ভালো লাগছিলো। ইচ্ছে ছিলো হাই-হ্যালো করি। কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু করলাম না। কারণ উনি আমাকে চেনেন না। একজন অপরিচিত মানুষ হিসেবে আমি যদি হাই-হ্যালো করি, তাহলে উনি হয়তো বিব্রতবোধ করবেন। এই ভেবে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
সবে দ্বিতীয় রাউন্ডের এক চতুর্থাংশ শেষ করেছি। তখনই হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো আমার পছন্দের একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর Md Al-Amin Akik ভাইয়ের সাথে। ভাইয়ের ভিডিও দেখি অনেকদিন আগ থেকেই। বিশেষ করে তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ সাইকেলে পাড়ি দেওয়া আর বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া, এই দুইটা ভিডিও আমার বেশ ভালো লেগেছে। তখন থেকেই মূলত আমি তার ভক্ত।
গতকাল ভাই আমার কমেন্টের রিপ্লাইতে বলেছিলেন, ২:১০/২:১৫ মিনিটে তিনি শেষ করবেন। তাই আমি ভেবেই নিয়েছিলাম ভাইয়ের সাথে হয়তো আমার দেখা হবে না। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিলো বলে দেখা হয়েই গেলো। আমার ধারণা ছিলো এটা উনার শেষ রাউন্ড। তবে উনাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি এটা উনারও দ্বিতীয় রাউন্ড। খানিকটা অবাক হলাম। যাক, ভালোই হলো। উনার আশেপাশে থাকলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারবো।
যাকগে, ভাইয়ের সাথে পরিচিত হলাম। ভাই অনেক ফ্রেন্ডলি। অল্পসময়েই আপন করে নিলেন। ভাইয়ের কাছে এসব দৌঁড় কিম্বা ম্যারাথন বিষয়ক টিপস চাইলাম। ভাই অনেক উপকারী টিপস দিলেন। আমরা একসাথে অনেকক্ষণ ছিলাম। বলতে গেলে দ্বিতীয় রাউন্ড প্রায় পুরোটাই ভাইয়ের সাথে কাটিয়েছি। অনেককিছু জেনেছি, শিখেছি। যেগুলো আগামীর ইভেন্টগুলোতে আমার বেশ কাজে লাগবে।
দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষদিকে হঠাৎ কোনো কারণে ভাই খানিকটা পিছিয়ে পড়লেন। আমিও হাইড্রেশন বুথের তালাশে একটু জোরে ছুটছিলাম। তখনই আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। পরে আর ভাইয়ের সাথে দেখা হলো না। ভেবেছিলাম দৌঁড় শেষ করে একবার দেখা করবো। ছবি তুলবো। কিন্তু এতোক্ষণ দৌঁড়ানোর ফলে শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিলো। সেখানে থাকার কোনো এনার্জিই ছিলো না। তাই মেডেল আর খাবার নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলাম।
এই ছিলো আমার প্রথম হাফ ম্যারাথনের গল্প। প্রথম সবকিছুই স্মৃতিময় হয়। কথায় আছে না—প্রথম প্রেম ভোলা যায় না—অনেকটা তেমনই। এই ইভেন্টের কথাও আমি কখনো ভুলবো না। এখানে এসে আমি অনেককিছু জেনেছি, অনেককিছু শিখেছি। যেগুলো পরবর্তী ইভেন্টগুলোতে বেশ কাজে লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস।
যারা এতোক্ষণ সময় নিয়ে পুরো লেখাটা পড়েছেন তাদেরকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। আর আমার জন্য দোয়া করবেন।