শুরুতে (রেস ট্র্যাক ভিজিট করার পর) আমি ভেবেছিলাম, হয়তো এই রেসে আর মেডেলটা পাবো না। এতো ভয়ঙ্কর রাস্তায় আমি এর আগে কখনোই সাইকেল চালাইনি। সবসময় পিচের রাস্তায় চালিয়ে অভ্যস্ত আমি। এমনকি এই রেসের জন্য প্র্যাক্টিসও করেছি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে। কিন্তু রেসে এসে দেখি ট্র্যাক পুরোই আলাদা। এমতাবস্থায় ভিরমি না খেয়ে উপায় ছিলো?
***
৩ অক্টোবর, ২০২৪। সকাল দশটা বাজে। গতকাল রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি কিছুটা থেমে এসেছে। আমি দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। গন্তব্য যাত্রাবাড়ী পকেট গেট। সেখানে রায়হান ভাই নামে একজন সাইক্লিস্ট আমাদের জন্য মিনি ট্রাক নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপাতত সেখানেই সবাইকে একত্রিত হতে বলা হয়েছে।
রাস্তায় নামার কিছুক্ষণ পরে আবারও শুরু হলো বৃষ্টি। পানিতে ডোবা রাস্তা আর বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আমি সাইকেল ছোটাচ্ছি। পুরো বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। কিছুই করার নেই। এমনিতেই বৃষ্টির কারণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। বেশি দেরি করলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কুমিল্লা থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
Cumilla MTB Challenge 2024 এ অংশগ্রহণ করতে ঢাকা থেকে আমরা পাঁচজন সাইক্লিস্ট (Dahfed Farsi, Sanjid Mollik, Noor Amin Purno, Khaza Baba এবং আমি) একসাথে যাচ্ছি। আমাদের সাইকেলগুলো যাতে ভালোভাবে নেওয়া যায় সেজন্য একটা মিনি ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। সবার সাইকেল ভালোভাবে বেঁধে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম কুমিল্লার উদ্দেশ্যে।
দুপুর তিনটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম CCN University তে। এখানেই রেস আয়োজিত হবে। শুরুতে ব্যাগপত্র রেখে হালকা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দুপুরে খাওয়া হয়নি। খাওয়াদাওয়া কোথায় করা যায় সেটা নিয়ে টিমমেটদের সাথে আলোচনা করছি—ঠিক এমন সময় আল আমিন আকিক ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম। বললেন, ‘এখনই আমরা রেস ট্র্যাক ভিজিট করতে বের হবো। রেসাররা জলদি প্রস্তুত হয়ে নিন।’
ব্যস, আমাদের আর খাওয়া হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম সাইকেল নিয়ে। রেসের আগেরদিন ট্র্যাক ভিজিট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে রেসের দিন খুব সহজ হয়। তাই এটা মিস করলে চলবে না।
ট্র্যাক ভিজিট শুরু হলো। সবাই ব্যাপক উৎসাহে প্যাডেলিং করছি। রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। কিন্তু কে জানতো এই সুন্দরই কিছুক্ষণ পর ভয়ঙ্কর সুন্দরে পরিণত হবে!
পিচের রাস্তা ছেড়ে গ্রাম্য আধপাকা রাস্তায় নেমে পড়তে হলো। ভাঙা রাস্তায় আমার সাইকেল চালানোর অভ্যেস নেই তেমন। তবুও ভালোই চালাচ্ছি। নতুন সাইকেল বিধায় মনের মধ্যে কিছুটা ভয়ও কাজ করছে। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করেই প্যাডেলিং করছি। ঠিক তখনই দেখা মিললো কর্দমাক্ত কাঁচা রাস্তার। আমি রীতিমতো ভড়কে গেলাম।
ছোটবেলা থেকেই আমার কাদায় ভীষণ ভয়। কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই মনে হয়—এই বুঝি পা পিছলে পড়ে গেলাম! এজন্য গ্রামের বাড়িতেও খুব একটা যাই না আমি। মোটকথা পুরোদস্তুর শহুরে বলতে যা বোঝায়, আমি ঠিক তাই।
রাস্তা দেখে আমার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেলো। এই রাস্তায় সাইকেল চালাতে হবে? এখানে হাঁটতেও তো পারবো না ঠিকমতো, সাইকেল কিভাবে চালাবো? তবুও হার না মেনে প্যাডেল ঘোরালাম। দেখতে দেখতে পার করে ফেললাম কাদার রাস্তা। তারপর একটু ভালো রাস্তার দেখা পেলেও তা খুবই অল্প সময়ের জন্য।
ট্র্যাক শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। পাক্কা ২১ কিলোমিটার। মাঝে কী সব রাস্তা যে অতিক্রম করে এসেছি! কখনো আপহিল তো কখনো ডাউনহিল। কখনো সাইকেল ঠেলে তুলেছি, আবার কখনো কাঁধে করে। সবমিলিয়ে খুবই ভয়ঙ্কর একটা অভিজ্ঞতা। ভাগ্যিস করুণাময় রক্ষা করেছিলেন। নয়তো খবরই ছিলো।
***
সন্ধ্যা থেকেই শুরু হলো কিট ডিস্ট্রিবিউশন। সবার মতো আমিও কিটব্যাগ সংগ্রহ করলাম। সাথে সান্ধ্যকালীন নাস্তাও ছিলো। যেহেতু প্রায় সারাদিনের না খাওয়া আমি। তাই শুরুতেই খাবারের উপর হামলে পড়লাম। খুব বেশি কিছু ছিলো না। একটা কলা, এক স্লাইস কেক আর ছোট্ট এককাপ রসমালাই। সাথে বড় এক বোতল পানি। সেগুলোই অনেকটা গোগ্রাসে গিললাম। কিন্তু ক্ষুধা মিটলো না। বরঞ্চ আরও বেড়েই গেলো। এখন কী করি? আশেপাশে তো খাবার হোটেলও নেই মনে হচ্ছে। মাথাটাই খারাপ হয়ে গেলো।
***
রাতের খাবারের আগে তাঁবু বন্টন করা হলো। ব্যাগপত্র তাঁবুতে রেখে নিচে চলে এলাম। আয়োজকদের পক্ষ থেকে টুকটাক সাইকেল সার্ভিসিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই যার যার সাইকেলের রোগবালাই সারিয়ে নিচ্ছে রেসের আগের রাতে। আমিও একফাঁকে সাইকেলটা সারিয়ে নিলাম। তারপর নির্ধারিত জায়গায় সাইকেল রেখে বেরিয়েছি, এমন সময় আল আমিন ভাইয়ের সাথে দেখা। আমাকে দেখেই জিগ্যেস করলেন, ‘রাতের খাবার খেয়েছো?’ আমি ‘না-সূচক’ মাথা নাড়তেই তিনি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ক্যান্টিনে চলে যাও। সেখানে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ আমি ‘জি আচ্ছা’ বলে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালাম।
রাতের খাবারটা দুর্দান্ত ছিলো। আনলিমিটেড ভাত-ডাল, সাথে সবজি আর মুরগি ভুনা—সবমিলিয়ে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া হলো। বিশেষ করে মুরগি ভুনাটা ছিলো অসাধারণ। সারাদিনের অভুক্ত আমি তাই উদরপূর্তি করে খেলাম।
খাওয়ার পর সকল রেসারদের অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হতে বলা হয়েছিলো। তাই খাওয়াদাওয়া শেষ করে ওদিকেই গেলাম। সকল রেসারদের উদ্দেশ্যে আয়োজকদের পক্ষ থেকে ব্রিফিং দেওয়া হলো। রেসের নিয়মকানুন বলে দেওয়া হলো। তারপর সবার জন্য শুভকামনা ব্যক্ত করে শেষ হলো ব্রিফিং সেশন।
তাঁবুতে ফিরেই বাঁধলো বিপত্তি। ছোট্ট একটা তাঁবুতে আমাদের তিনজনকে (আমি, রায়হান ভাই এবং মল্লিক ভাই) থাকতে দিয়েছে। রায়হান ভাই শোয়ার পর তাঁবুর আর অর্ধেকটা জায়গা বাকি আছে। এইটুকু জায়গায় আমি আর মল্লিক ভাই কিভাবে শোবো সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ পর এলো নুর ভাই। জিগ্যেস করলাম,
: তাঁবু পেয়েছেন?
: না তো। আমি তো আসলামই কেবল।
: যাক ভালোই হলো। আপনি আর মল্লিক ভাই তাহলে আরেকটা তাঁবু দখল করেন।
তারপর ভলান্টিয়ার একজনকে ডেকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে সে আরেকটা তাঁবুর ব্যবস্থা করে দিলো।
***
রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। কারা যেন চিল্লাপাল্লা করে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ঘুমাতে ঘুমাতে তাই রাত একটা। এখন আবার ঘুম ভেঙে গেলো। আসলে অপরিচিত জায়গায় ঘুমানো আমার জন্য বেশ কষ্টকর। অভ্যেস নেই তো, তাই বেশ প্যারা খেতে হয়। কিছুই করার নেই। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।
পৌনে পাঁচটার দিকে সকল রেসারকে ক্যান্টিনে যেতে বলা হলো। সবার জন্য আর্লি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে খাবারটা সংগ্রহ করলাম। খুব বেশি কিছু না। একটা কলা, ডিম সেদ্ধ আর স্যান্ডউইচ ব্রেড। রেসের আগে এটুকুই যথেষ্ট। খাওয়া শেষ করে চলে গেলাম রিপোর্টিং পয়েন্টে। সাড়ে পাঁচটায় রিপোর্টিং। ছয়টা থেকে রেস শুরু। সবাই এসে উপস্থিত হলে আয়োজকরা পজিশন নির্ধারণ করে দিলেন। সবার শুরুতে রাখা হলো পোডিয়াম সাইক্লিস্টদের। তারপর সাধারণ এবং সবার শেষে রাখা হলো মেয়ে সাইক্লিস্টদের।
ঠিক ছয়টায় রেস শুরু হলো। সবাই তুমুল গতিতে প্যাডেল মারছে। আমিও চেষ্টা করছি। যেভাবেই হোক, কাট অফ টাইমের (২ ঘন্টা ২০ মিনিট) মধ্যেই আমাকে শেষ করতে হবে। এতো কসরত করেও যদি শেষপর্যন্ত মেডেল না পাই তাহলে ব্যাপারটা খুবই হতাশাজনক হবে। তাই নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি।
গতকাল এসে ট্র্যাক ভিজিট করে যাওয়ার সুফল পেলাম আজ। রাস্তাটা চেনা চেনা লাগছে বিধায় ভালো করে টানতে পারছি। গতকাল যেমন প্যারা খেয়েছিলাম আজ তেমনটা খাচ্ছি না। তবুও কর্দমাক্ত রাস্তাটা শুরু হতেই আমার গতি শ্লথ হয়ে গেলো।
একেবারে গ্রামের ভেতর দিয়ে সাইকেল ছোটাচ্ছি। গ্রামের পিচ্চিপাচ্চা থেকে শুরু করে মুরুব্বিরা, এমনকি মহিলারাও তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেখছে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা আমাদেরকে চিয়ারআপ করছে। হাততালি দিচ্ছে। আমাদের সাথে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসবের মধ্যে সাইকেল চালাতে বেশ লাগছিলো। পুরো ভিন্ন এক অনুভূতি। কোনো রেসার পড়ে গেলে সাথে সাথে তাকে তুলে দিচ্ছিলো। পিঠ চাপড়ে সাহস দিচ্ছিলো। গ্রামবাসীর এমন সহানুভূতি দেখে আমি আপ্লূত না হয়ে পারলাম না। একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো আমার তনু-মনে।
নিজেকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ১ ঘন্টা ৪৬ মিনিটে আমি রেস শেষ করলাম। রেস শুরু করার সময় যেখানে ভয় পাচ্ছিলাম সময়মতো শেষ করতে পারবো কিনা, সেখানে সময়ের প্রায় ৩৪ মিনিট আগেই শেষ করলাম। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে গেলো। আমি মূলত রানিং বা সাইক্লিং ইভেন্টে অংশগ্রহণ করিই এজন্য। যাতে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারি। মানুষ যখন নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যায় তখন তার আত্মবিশ্বাস আপনাআপনিই বেড়ে যায়।
***
সাইকেলটা কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। আমারও একই অবস্থা। তাড়াতাড়ি ধুয়ে ফেলতে হবে। এদিকে সাইকেল ধোয়ার জায়গায় লম্বা লাইন। আমি সাইকেলটা রেখে মেডেল সংগ্রহ করলাম। খুবই ভালো লাগছে। এই মেডেলটা অর্জন করতে কতই না প্যারা খেতে হলো! এতকিছুর পর শেষমেশ যখন প্রাপ্তি ঘটলো, তখন সব কষ্ট নিমিষেই উবে গেলো যেন।
***
রেসের পর পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হলো। সাইকেল ধোয়ার চক্করে অনুষ্ঠানটা মিস করলাম। সবশেষে ছিলো খাওয়ার ব্যবস্থা। আমি সাইকেলটা কোনোমতে পরিষ্কার করে নিজেও গোসল সেরে নিলাম। তারপর ক্যান্টিনে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করলাম। ভালো খাবারের ব্যবস্থাই করা হয়েছে। চিকেন বিরিয়ানি—সাথে একটা করে মোজো, ভোল্টেজ আর পানির বোতল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
খুব চমৎকার একটা ইভেন্ট ছিলো। আয়োজকদের ডেডিকেশন ছিলো দেখার মতো। বিশেষ করে Md Al-Amin Akik ভাইয়ের কথা না বললেই না। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই তিনি আন্তর্জাতিক একটা ইভেন্টে (IRONMAN 70.3) অংশগ্রহণ করবেন। সেটা রেখে তিনি এই ইভেন্টের পেছনে পরিশ্রম করেছেন। এই দুটো দিন ভাইকে দৌড়ের ওপরেই দেখলাম কেবল। তাই ভাইয়ের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আপনার আপকামিং ইভেন্টের (IRONMAN 70.3) জন্য শুভকামনা রইলো। করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি—আপনি যাতে দেশের জন্য দারুণ এক অর্জন নিয়ে ফিরতে পারেন।
এছাড়াও Triathlon Dreamers ও Team Kotbari এর মেম্বাররা খুব পরিশ্রম করেছেন। ঢাকা থেকেও শুনলাম বেশকিছু ভাই ভলান্টিয়ার হিসেবে গিয়েছিলেন। তারাও পরিশ্রম করেছেন। তাদের সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই এতো সুন্দর একটা ইভেন্ট আয়োজিত হলো। সেজন্য সকলের প্রতিই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আর হ্যাঁ, কিছু ভুলত্রুটি অবশ্যই ছিলো। আমি সেটা অস্বীকার করবো না। কিন্তু সেই ছোটোখাটো ভুলগুলোকে ইস্যু করে আমরা যদি তাদের এফোর্টটাকে ধামাচাপা দেই তাহলে তাদের প্রতি বড্ড অবিচার করা হবে। একজন সুস্থ মনের মানুষ কখনো এটা করতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস।