সকাল নয়টা। সাকিব ভাইয়ের অনবরত ডাকাডাকিতে ঘুমের বারোটা বেজে গেলো। এমনিতেই রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছি। তার উপর সকাল সকাল এতো ডাকাডাকি করলে হয়? খানিকটা বিরক্তির সুরে বললাম, ‘কী হয়েছে ভাই, এতো ডাকাডাকি করছেন কেন?’ সে বললো, ‘আজকে সকালে যে উত্তরায় যেতে হবে, সেটা ভুলে গেছো নাকি? তাড়াতাড়ি রেডি হও। দেরি হলে তো সমস্যা। পরে কাজের কাজ কিছুই হবে না।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানার মায়া কাটাতে হলো। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। তারপর রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের মূল গন্তব্য উত্তরা। তবে এখন আমরা যাচ্ছি মতিঝিলে। সেখান থেকে মেট্রোরেলে চেপে উত্তরা যাবো। তা না হলে দু-তিন ঘণ্টার আগে তো ভুলেও যাওয়া যাবে না। ঢাকাশহর তো, জ্যামে বসে থাকতে থাকতেই দিন শেষ হয়ে যাবে।
মতিঝিল মেট্রো স্টেশনে ঢুকে খানিকটা স্বস্তি পেলাম। ভেন্ডিং মেশিনে আজকে কোনো ভীড়ই নেই। পুরো ফাঁকা। এমন ফাঁকা পাবো কল্পনাও করিনি। আমি ঝটপট আমার র্যাপিড পাসে দুশো টাকা রিচার্জ করে নিলাম। তারপর সাকিব ভাই আর আবদুল হান্নানকে টিকেট কেটে দিলো তানভীর। ওর কাছেও র্যাপিড পাস আছে, তাই আর টিকেট কাটতে হলো না।
প্ল্যাটফর্মে এসে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। দু-তিন মিনিট পরেই হয়তো ছেড়ে দিবে। লোকজন সবাই সিটে বসে আছে। একটু দেরি হওয়ায় আমরা সিট পেলাম না। তবুও সমস্যা নেই। মেট্রোরেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ভ্রমণ করা যায়। অতো একটা অসুবিধা হয় না।
নির্ধারিত সময়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো। ভালোই লাগছে। মেট্রোরেল বাংলাদেশের উন্নয়নে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে। বিশেষ করে ঢাকাশহরের যানজট এড়াতে এর কোনো বিকল্পই ছিলো না। এখন শুধুমাত্র একটা লাইনের (মতিঝিল-উত্তরা) কাজ শেষ হয়েছে। শুনেছি, মোট ছয়টা লাইন নাকি হবে। বাকিগুলোর কাজ শেষ হলে ঢাকাশহরে চলাফেরা করতে আর কোনো অসুবিধাই হবে না। আমি এখন মিরপুর বা তার আশেপাশে যেতে হলে মেট্রো দিয়েই যাই। টাকা একটু বেশি লাগে যদিও। কিন্তু সময়টা তো বেঁচে যায়। আর কষ্টও কম হয়।
আজকে উত্তরায় একটা কাজে যাচ্ছি ঠিকই, তবে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আমার মূল টার্গেট ছিলো মেট্রোরেলে মতিঝিল থেকে উত্তরা কভার করা। আগে কয়েকবারই চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সময়-সুযোগ মেলেনি বিধায় হয়ে ওঠেনি। এখন ছুটি চলছে। তাই সুযোগটাকে হাতছাড়া করলাম না।
মতিঝিল থেকে ছেড়ে ট্রেন ছুটে চললো উত্তরার দিকে। বাংলাদেশ সচিবালয় হয়ে ঢুকে পড়লো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এড়িয়াতে। ওইতো দেখা যাচ্ছে বিখ্যাত কার্জন হল। সেই ১৯০৪ সালে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন এটির ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকে আজ অব্দি তা দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। অনিন্দ্যসুন্দর এই ভবনটির গায়ে লেখা—Department of Chemistry। এটাও আমাদের নজর এড়ালো না।
দেখতে দেখতে আমরা টিএসসি চত্বর পার হলাম। ডানে বিখ্যাত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। যা পূর্বে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিলো। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানেই সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সে বছরেরই ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এসব মনে করে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম ভাবনার জগতে। মনে হচ্ছিলো, এসব যেন এখনই ঘটছে। আর আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে সব দেখতে পাচ্ছি।
এই হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইতিহাস। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের ক’জনই-বা এগুলো জানে! যদি জিগ্যেস করা হয়, বিখ্যাত রেসকোর্স ময়দান কোনটা বলো তো? তাহলে অনেকেই উত্তর দিতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে চেনে। কিন্তু অন্য পরিচয়ে। কী সেই পরিচয়?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে তারা চেনে বইমেলার জন্য। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলা। এটাকে লেখক-পাঠকদের মিলনমেলাও বলা চলে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে ম ম করে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ছুটির দিনগুলোতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পছন্দের লেখকের সাথে দেখা করতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে পাঠকেরা। চলে অটোগ্রাফ-ফটোগ্রাফ। দিনশেষে তারা প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফওয়ালা বই নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
আমরা শাহবাগ পাড়ি দিলাম। তারপর ঢাকার বিখ্যাত পাঁচতারা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও-এর পাশ দিয়ে ট্রেন প্রবেশ করলো কারওয়ান বাজার স্টেশনে। সেখান থেকে ফার্মগেট হয়ে ট্রেন এগোতে লাগলো বিজয় স্মরণীর দিকে। সহসাই চোখে পড়লো দেশের সবচেয়ে সুন্দরতম স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবন। ছোট থেকে ঢাকায় বেড়ে উঠার সুবাদে অনেকবারই সংসদ ভবন দেখতে আসার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এভাবে উপর থেকে আগে কখনোই দেখিনি।
উপর থেকে নাকি যেকোনো জিনিসই সুন্দর লাগে দেখতে। আর যদি সেটা হয় অতীব সুন্দর কোনো জিনিস—তাহলে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। সত্যি বলতে, সংসদ ভবনের সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে ছিলাম। আচমকাই আমার ঘোর কাটলো। দেখলাম ট্রেন আগারগাঁও স্টেশনে প্রবেশ করছে। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে সিটে বসে থাকা একজন নেমে গেলেন। আমি সেই সিটে বসলাম। ভীড়ের মধ্যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে একটু কষ্টই হচ্ছিলো। বসতে পেরে যেন একটু স্বস্তি পেলাম।
জার্নিটা বেশ উপভোগ করছিলাম। ভাবছিলাম, পুরো ঢাকাশহরকে যদি মেট্রোরেলের আওতায় নিয়ে আসা যেতো—তাহলে কতোই-না ভালো হতো! অহেতুক জ্যামে বসে সময়ও নষ্ট হতো না। সেইসাথে কষ্টটাও কমতো। বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকতো তখন সবাই। কাজের গতিও অটোমেটিক বেড়ে যেতো।
এসব আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে কখন যে মিরপুর ১০-এ এসে পড়লাম টেরই পাইনি। এখান থেকে ইশতিয়াক যুক্ত হলো আমাদের সাথে। মেট্রোরেলে মিরপুর ১০ থেকে উত্তরা খুব বেশি দূরে নয়। মাঝে চারটা স্টেশন পড়লো। পঞ্চম স্টেশন উত্তরা উত্তরে গিয়ে আমরা নেমে পড়লাম। ট্রেন এর বেশি যাবে না। তাই আমাদেরকে এখানেই নেমে পড়তে হলো।
দ্রুত কাজ শেষ করে আমরা আবার উত্তরা উত্তর স্টেশনে চলে এলাম। এবার আমরা মতিঝিল ফিরে যাবো। স্টেশনে ঢুকে আমাদের চোখ ছানাবড়া। টিকেটের জন্য বিশাল লম্বা লাইন। যদিও তাড়াতাড়িই এগোচ্ছে। সাকিব ভাই আর আবদুল হান্নানকে টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমি আর তানভীর র্যাপিড পাস ব্যবহার করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
প্ল্যাটফর্মে তখন একটা ট্রেন দাঁড়ানো ছিলো। তবে আমরা সেটায় উঠলাম না। কারণ ওদের টিকেট কেটে উপরে আসতে সময় লাগবে। আমরা ট্রেনে উঠার পর যদি ছেড়ে দেয় তাহলে তো সমস্যা। এরচেয়ে বরং খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেই। আমি বসার একটা জায়গা খুঁজে বসে পড়লাম।
অবশেষে সাকিব ভাইয়েরা আসলো। ততক্ষণে চলে গেছে দুটো ট্রেন। খুব সম্ভবত ১১ মিনিট পরপর একটা করে ট্রেন আসে। যাকগে, ব্যাপার না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকটা চলে আসবে। আমরা প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলে এলো। আমরা দ্রুত উঠে সিটে বসে পড়লাম। যাক বাবা, এবার আরামসে যাওয়া যাবে। ট্রেন চলতে শুরু করলো। আবারও সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। তবে এবার আকাশটা মেঘলা ছিলো। তাই সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগছিলো। সকালের দৃশ্যগুলোর সাথে মেলানো যাচ্ছিলো না। আমি ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের সৌন্দর্য মুগ্ধনয়নে উপভোগ করছিলাম। ওদিকে সাকিব ভাই ঘুমিয়ে একাকার।