Abu Bakar Siddique

প্রথমবার ভারত ভ্রমণের আদ্যোপান্ত – দ্বিতীয় পর্ব

বিদেশ ভ্রমণ

৫ম দিন

রাতে ভালো ঘুম হলো। যদিও অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু ওইটুকু ঘুমানোর ফলে শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগছিলো। খুব ভোরেই আমরা হোটেল থেকে চেক-আউট করে ফেললাম। বাইরে এসে হেঁটে হেঁটেই চলে গেলাম জেনারেল বাসস্ট্যান্ডে। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটা লোকাল গাড়ি ভাড়া করলাম। সে আমাদেরকে নিয়ে যাবে অনন্তনাগ পর্যন্ত। সেখান থেকে আবার পেহেলগামের গাড়িতে তুলে দিবে।

গাড়ি যতক্ষণে ছাড়লো ততক্ষণে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জম্মু শহর থেকে বের হতেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো পাহাড়ি আঁকাবাকা পথ। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা চলে এলাম বানিহালের কাছাকাছি। ড্রাইভার তখন কিছু সময়ের জন্য বিরতি দিলো। আমরা নাস্তা সেরে একটা কড়া চা নিলাম। শরীরটা আবার বেশ চাঙ্গা হয়ে গেলো।

তারপর এক টানে চলে এলাম অনন্তনাগ। আমাদের ড্রাইভারটাও ছিলো বেশ অমায়িক। সে আমাদেরকে পেহেলগামের একটা গাড়িতে তুলে দিলো। আমরা দুপুর তিনটার মধ্যেই পেহেলগামে চলে আসি।

পেহেলগাম নেমেই আমরা একটা গেস্ট হাউজে চেক-ইন করলাম। তাদের সাথেও ভাড়া নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ দরদাম করে নিলাম। তারপর সব ঠিকঠাক হলে আমরা ব্যাগপত্র নিয়ে রুমে ঢুকে ফ্রেশ হলাম। এখানে আমার সাজেশন থাকবে, যারা কম বাজেটে ট্যুর দিবেন তারা অবশ্যই হোটেলের পরিবর্তে গেস্ট হাউজগুলোতে থাকার চেষ্টা করবেন। কারণ এতে করে খরচ কিছুটা বেঁচে যায়। 

ব্যাগপত্র রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম দুপুরের খাবার খেতে। বেশ অনেকটা দূরে গিয়ে একটা হোটেলে বাসমতী চালের ভাত, গরুর ঝাল ফ্রাই এবং একধরনের কাবাব (নামটা ঠিক মনে নেই) দিয়ে দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম। খাবারের পর এককাপ ঘন দুধের চা। উফ, স্বর্গীয় সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।

বাকি সময়টুকুও ঘোরাফেরা করেই কাটালাম। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে শীতটা বেশ জাঁকিয়ে নামলো। ভাগ্যিস প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলাম। নাহলে অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো। ইতোমধ্যে আমাদের সাথে আরও ২ জন এসে যুক্ত হয়েছে। এখন আমরা ৬ জনের একটা টিম। সবাই মিলে শিক কাবাব আর রুটি দিয়ে রাতের খাবারটা সেরে নিলাম তাড়াতাড়ি। তারপর সোজা গেস্ট হাউজে।

খরচ :

১. জম্মু থেকে অনন্তনাগ = ৪০০₹

২. সকালের নাস্তা = ৬০₹

৩. যাত্রাবিরতিতে চা-কফি = ৪০₹

৪. অনন্তনাগ থেকে পেহেলগাম = ১০০₹

৫. গেস্ট হাউজ ভাড়া = ২০০₹

৬. দুপুরের খাবার = ২০০₹

৭. রাতের খাবার = ১২০₹

• মোট = ১,১২০₹ (১,৫৫৬৳)

৬ষ্ঠ দিন

রাতটা খুব কষ্টে কাটালাম। প্রচন্ড শীত। তার উপর রুম হিটারও নেই। নেই পাওয়ারব্ল্যাঙ্কেটও। কোনোভাবে রাতটা কাটিয়ে সকালে গরম পানি দিয়ে গোসল করার পর খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম। তারপর গরম কাপড়চোপড় পরে বাইরে বের হলাম। ভেবেছিলাম, বাইরেও মনে হয় এমন ঠান্ডাই থাকবে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে পুরো বোকা বনে গেলাম। ভালোই রোদ উঠেছে আজকে। তবে রোদটা ছিলো সহনশীল। বেশ আরাম লাগছিলো। একটা হোটেলে গিয়ে সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম। তারপর একটা গাড়ি রিজার্ভ করে চলে গেলাম আরু ভ্যালি। আরু ভ্যালিতে বেশি সময় না দিয়ে চলে গেলাম চন্দনওয়ারী। সেখানে বেশ অনেকক্ষণ ছিলাম। খুবই চমৎকার একটা জায়গা। বরফগলা ঠান্ডা পানি ঝর্ণা হয়ে নামছিলো। সেখানে ছবি তুলে আমরা আবার রওনা দিলাম বেতাব ভ্যালির উদ্দেশ্যে। বেতাব ভ্যালি ঘুরে আমরা আবার পেহেলগাম ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে ফিরে আসি। ততক্ষণে সকাল গড়িয়ে দুপুর।

রাস্তার পাশে একটা একটা জায়গা থেকে দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম। তারপর ঘোড়াওয়ালাদের সাথে অনেকক্ষণ দরদাম করে ঘোড়া নিলাম মিনি সুইজারল্যান্ডখ্যাত বাইসারান ভ্যালিতে যাওয়ার জন্য। ওই জার্নিটুকু আমার আজীবন মনে থাকবে। এমন এডভেঞ্চার আমার জীবনে এবারই প্রথম। তাই আমার সাজেশন থাকবে, ঘোড়া নিয়ে বাইসারান ভ্যালিতে অবশ্যই যাবেন।

বাইসারান ভ্যালির কাছাকাছি আসতেই শুরু হলো বৃষ্টি। তবে বৃষ্টির সাথে হালকা বরফের কণাও পড়ছিলো। তুষার বা স্নো যাকে বলে আরকি। আমরা ঘোড়া থেকে নেমে টিকেট কেটে বাইসারানে প্রবেশ করলাম। এই সময়টাতে বাইসারান তেমন একটা সুন্দর লাগে না। শুধু ঘোড়ায় চেপে আসা-যাওয়ার জার্নিটাই রোমাঞ্চকর ছিলো।

সন্ধ্যার আগেই আমরা ফিরে আসি পেহেলগাম ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে। একটা ক্রিসটা গাড়ি রিজার্ভ করে আমরা রওনা দিলাম গুলমার্গের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় একটা জায়গায় ড্রাইভার বিরতি দিলো। আমরা তখন কাশ্মীরের ট্রেডিশনাল কাহওয়া চা চেখে দেখলাম। আমার সঙ্গীদের কাছে অনেক ভালো লাগলেও আমার কাছে তেমন একটা ভালো লাগেনি। শুধুমাত্র ট্রেডিশনাল বলেই একবার চেখে দেখলাম।

রাত দশটার দিকে আমরা গুলমার্গে পৌঁছলাম। শুরুতে দুয়েকটা হোটেল দেখলাম। এখানে হোটেল ভাড়া কিছুটা বেশি। কিছু করার নেই। ভাড়া নাকি আরও বাড়বে জানুয়ারির দিকে। এমনটাই বললো সেখানকার লোকাল মানুষজন। যাকগে, আমরা মোটামুটি ৩★ মানের একটা হোটেলে উঠলাম। রুম হিটার আছে জেনে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। রুমে ঢুকেই শরীরটা গরম করে নিলাম। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে প্রচন্ড। এতো রাতে কোনো খাবার হোটেলও খোলা পাবো কিনা কে জানে?

শেষমেশ আমাদের হোটেলের ম্যানেজারের সহায়তায় একটা খাবার হোটেল খোলা পাওয়া গেলো। সেখান থেকে ভাত, ডিম ভুজিয়া আর ডাল ভুনা পার্সেল করে নিয়ে আসলাম। খরচটা পড়েছিলো অনেক। কিন্তু আমরাও ছিলাম অপারগ। তাই দামের দিকে তাকানোর মতো অবস্থা ছিলো না। কোনোমতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে সোজা বিছানায় চলে গেলাম।

খরচ :

১. সকালের নাস্তা = ৮০₹

২. গাড়ি ভাড়া = ৪২০₹

৩. দুপুরের খাবার = ১০০₹

৪. ঘোড়া দিয়ে বাইসারান ভ্যালি = ৫০০₹

৫. বাইসারান ভ্যালির টিকেট = ৩০₹

৬. পেহেলগাম থেকে গুলমার্গ = ১,০০০₹

৭. হোটেল ভাড়া = ৬৬৬₹

৮. রাতের খাবার = ২৬০₹

• মোট = ৩,০৫৬₹ (৪,২৪৮৳)

৭ম দিন

ভারত ভ্রমণের ৭ম দিনের শুরুটা হলো স্বপ্নের মতো। গতকাল রাতে যখন গুলমার্গ এসে নামি তখন বেশ হতাশই হয়েছিলাম বরফ দেখতে না পেয়ে। আমাদের ধারণা ছিলো, গুলমার্গ বরফে আচ্ছাদিত থাকবে। কিন্তু আসার পর যখন তার উল্টোটা দেখলাম, তখন সত্যি খুব খারাপ লাগছিলো। তবে এই খারাপ লাগাটাই যে একটা রাতের ব্যবধানে তুমুল ভালোলাগায় পরিণত হবে, তা কে জানতো?

সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে একেবারে ‘থ’ বনে গেলাম। প্রকৃতি এভাবেও তার রূপ পাল্টাতে পারে? রাতে ঘুমানোর আগে যেখানে দেখেছিলাম কোনো বরফের একটা কণাও নেই, সেখানে ঘুম থেকে উঠে দেখছি বরফে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। তুষারপাতও হচ্ছে বেশ জাঁকিয়ে। এমন দৃশ্য দেখার জন্য সত্যিই আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। যাক, আমাদের কাশ্মীর আসাটা সার্থক হলো।

আমরা ফ্রেশ হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। একটা জায়গায় সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে একটা দোকান থেকে শীতের জ্যাকেট আর বড় জুতা ভাড়া করলাম। তারপর হাঁটা দিলাম সোজা গন্ডোলা স্টেশন অভিমুখে। পথে যেতে যেতে চমৎকার সব দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছিলাম। আরেকটা কথা, এই মৌসুমের প্রথম তুষারপাত ছিলো এটাই। এখানকার লোকাল মানুষজন বলছিলো, আপনারা সত্যিই ভাগ্যবান। গতকাল পর্যন্ত যারা ঘুরে গেছে, তারাও হতাশ হয়ে বরফ দেখতে না পেয়ে। কিন্তু আপনারা এসেই তুষারপাত পেয়ে গেলেন।

তবে ভাগ্য তো আর সবসময় সহায় হয় না। এবারেও পেলাম তার প্রমাণ। মৌসুমের প্রথম তুষারপাতের কারণে গন্ডোলা আজ বন্ধ। অনেক শখ ছিলো গন্ডোলায় চড়ার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, শখটা পূরণ হলো না। পরে আর কী? খানিকটা হতাশ মনে সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার হোটেলে ফিরে আসলাম। হোটেল থেকে চেক-আউট করে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিলাম। তারপর একটা গাড়ি রিজার্ভ করে রওনা দিলাম কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে।

শ্রীনগর পৌঁছুতে রাত আটটা বেজে গেলো। ড্রাইভারের সহায়তায় একটা গেস্ট হাউজ খুঁজে বের করে সেখানে উঠে পড়লাম। ব্যাগপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে আবার বের হলাম। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর সোজা গেস্ট হাউজে ফিরে আসলাম।

খরচ :

১. সকালের নাস্তা = ১০০₹

২. শীতের পোশাক ও জুতা = ১৫০₹

৩. দুপুরের খাবার = ২০০₹

৪. গুলমার্গ থেকে শ্রীনগর = ৪২০₹

৫. গেস্ট হাউজ ভাড়া = ৩৪০₹

৬. রাতের খাবার = ৩০০₹

• মোট = ১,৫১০₹ (২,০৯৮৳)

৮ম দিন

আমাদের আজকের প্ল্যান ছিলো, আমরা সোনামার্গ হয়ে কারগিল যাবো। কারণ সোনামার্গে দেখার মতো তখন শুধু বরফই ছিলো। আমাদের পরিচিত দুজন আগেরদিন সোনামার্গে ঘুরে এসেছিলেন। তাদের সাজেশন ছিলো, শুধু সোনামার্গ না গিয়ে একেবারে কারগিল চলে যায়েন। তাহলে যাওয়ার সময় চাইলে সোনামার্গেও কিছুক্ষণ ঘুরে যেতে পারবেন।

সকালে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে গিয়ে খবর পেলাম, অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে কারগিলের রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। আজকে আর ওদিকে যাওয়া সম্ভব না। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু নসিবে না থাকলে কীই-বা করা যাবে?

পরে আমরা ঠিক করলাম, আজকে পিকনিক করবো। গেস্ট হাউজের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে তাদের রান্নাঘর ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে নিলাম। তারপর বাজারে গিয়ে ইচ্ছেমতো বাজার করে নিয়ে এলাম। গরুর গোস্তো, রুই মাছ, ডিম, শাকসবজি। সবমিলিয়ে প্রায় অনেকগুলো বাজার করে ফেললাম। তারপর সবাই মিলে হাতে হাতে কাটাকুটি এবং রান্নাবান্নার কাজটা শেষ করলাম।

দুপুরের খাওয়াটা জবরদস্ত হলো। খাওয়ার পরে হালকা বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ঘাটে এসে দুটো শিকারা নিলাম ২ ঘন্টার জন্য। অবশ্য অনেক দরদাম করেই নিয়েছি। তারপর ডাললেকে দিনটা শেষ করে সন্ধ্যার দিকে ঘাটে এসে নামলাম। শিকারার ভাড়া মিটিয়ে ওদিকে খানিকটা সময় ঘোরাঘুরি করে গেস্ট হাউজে ফিরে গেলাম। সেখানে রাতের খাবারটা রান্না করাই ছিলো। সেটা খেয়ে নিয়ে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।

খরচ :

১. বাজার-সদাই/খাবার-দাবার = ৩০০₹

২. শিকারা রাইড = ১৩০₹

৩. গেস্ট হাউজ ভাড়া = ৩৪০₹

• মোট = ৭৭০₹ (১,০৭০৳)

লিখেছেন : 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আমার সম্পর্কে

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit.

গ্যালারি

আমাকে অনুসরণ করুন